নিজস্ব প্রতিবেদক: রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মাংসের বাজারে শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর প্রতারণা। টাটকা গরুর মাংস ভেবে আমরা যা কিনে খাচ্ছি দেখা যাচ্ছে তা গরুর মাংসই নয়। এটি আসলে দীর্ঘদিন আগের বিদেশ থেকে আসা কার্টন-প্যাকেটজাত মহিষের বা অন্য কোনো পশুর মাংস। বক্সের ওই মাংস কোল্ড স্টোরেজ বা গুদাম থেকে গভীর রাতে বের করে ভোর রাতের মধ্যেই তা সদ্য জবাইকৃত গরুর মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে। চরম উদ্বেগের বিষয় হলো এসব কার্টনের গায়ে মহিষের মাংস উল্লেখ থাকলেও আদৌ এগুলো কিসের মাংস, কোন দেশ থেকে আনা, মানসম্পন্ন কিনা বা মেয়াদ ঠিক আছে কিনা তা নিয়ে খোদ বিক্রেতারাই সন্দিহান। নেই বিএসটিআই বা গুনগত মান সংক্রান্ত কোনো সিল বা নমুনা। এমন প্রেক্ষাপটেও কেবলমাত্র অধিক মুনাফার লোভেই ভয়ানক এ প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির মাংস ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উপজেলার ভূলতা তাঁত বাজারের পিছনের গেইটের সামনেই ফ্রিজজাত গাড়ি দিয়ে আসতে দেখা যায় এসব প্যাকেটজাত মাংস। অনুসন্ধানে দেখা গেছে এ অপকর্মের মূলঘাঁটিই তাঁত বাজার। এখান থেকেই মূলত প্যাকেটজাত কথিত মহিষের মাংস বিশেষ কৌশলে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গরুর মাংস হিসেবে বিক্রি বা সরবরাহ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্যাকেটজাত মাংস সরবরাহ হচ্ছে বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, তেহারি বা বিরিয়ানি হাউস ও চাইনিজ হোটেল। পাশাপাশি কৌশলে কিছুটা বিক্রি করা হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের কাছেও। পাইকারী মাত্র ২৫০টাকা কেজি দরের প্যাকেটজাত মহিষের মাংস গরুর মাংসের সঙ্গে মিশিয়েই তা দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ৪৫০থেকে ৫০০টাকায়। ৫০ কেজি গরুর মাংসের সঙ্গে ১৫০ কেজি প্যাকেটজাত মহিষের মাংস মিশিয়ে হরহামেশায় বিক্রি করা হচ্ছে। সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, সময় তখন রোববার ভোর রাত সাড়ে ৫টা। তাঁত বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। নিচতলায় প্রান্তে একটি মাত্র প্রবেশপথ খোলা ছিল। প্রবেশ দ্বারের কেঁচিগেট পেরিয়ে এগোতেই মাংস কাটার ও কসাইদের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। কাছে গিয়ে দেখা গেল মাংসের দোকানগুলোর সদ্য জবাই করা গরুর বিভিন্ন অংশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ সময় দেখা যায়, এক পাশে জবাই করা সেই গরুর মাংস ছোট ছোট করে কাটা হচ্ছে, অন্যপাশেই কার্টন ও পলিথিনের প্যাকেট থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস বের করে ছোট সাইজ করা হচ্ছে। এ সময় প্যাকেটজাত মাংসগুলো জবাইকৃত গরুর মাংসের সঙ্গে মেশাচ্ছিলেন দোকানের এক কর্মচারী। তার নাম জানা যায়নি। এ ছাড়া আরেক দোকানে কার্টন থেকে চারটি পলিথিন প্যাকেটের হিমায়িত মাংস বের করেও সেখানে গরুর মাংসের সঙ্গে মেশানোর কাজ করতে দেখা যায়। হিমায়িত হলেও প্যাকেটের মাংসগুলো তখন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নরম হয়েছিল। হিমায়িত মাংসে ও প্যাকেটের গায়ে দেখা যায় মরা কালচে রক্ত। এমন অরুচিপূর্ণ হিমায়িত মাংসই মেশানো হচ্ছিল টাটকা গরুর মাংসের সঙ্গে। একইভাবে এ দোকানের পূর্বপাশের দোকানে তখন ছিল প্রায় ১৫টি কার্টন। যার প্রতিটিতে ছিল ২০ কেজি করে প্যাকেটজাত মাংস। লাল ও হলুদ রঙের ওই কার্টনগুলোর গায়ে ইংরেজিতে বড় করে লেখা ছিল “সামির”। তার নিচে লেখা ছিল ‘ফ্রজেন বনলেস বাফেলো মিট’ অর্থাৎ হিমায়িত হাড়মুক্ত মহিষের মাংস। আরেক পাশে লেখা ‘আল্লানা”। ওজন ২০ কেজি। আরেকদিকে সাদা কাগজের ওপর পিন্ট করা কিউআর কোড, রফতানি তথ্য ও মেয়াদ। ২০২০ সাল পর্যন্ত এসব কার্টনে মেয়াদ উল্লেখ থাকলেও, আদৌ তা সঠিক কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লেখা ছিল “আল সামির এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড ইন্ডিয়া। তবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম কার্টন বা প্যাকেটের গায়ে উল্লেখ দেখা যায়নি। তবে জানা গেছে, দেশি ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান এগুলো আমদানি করেছে। এরকম আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হিমায়িত মাংস আমদানি করছে। তাঁত বাজারে হিমায়িত মহিষের মাংস গরুর মাংসের সঙ্গে মেশানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত কর্মীরা (কসাই)বলেন, এসব প্যাকেটজাত মাংসের বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। দোকান মালিকরা যেভাবে বলেন সেভাবেই কাজ করেন। তারা বলেন, এসব প্যাকেটজাত মাংস বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা খাবার দোকানে সরবরাহ করা হয়। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন তারা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁত বাজারের মাংসের দোকানের একজন কর্মী বলেন, এই প্যাকেটের মধ্যে আদৌ মহিষের মাংস কিনা আমরা নিজেরাও সন্দিহান। মানুষকে কী খাওয়াচ্ছি তা নিয়ে ভাবতে গেলে খারাপ লাগে। কিন্তু আমরা তো মহাজনের চাকরি করি, পেটের দায়ে এসব দেখেও কিছু করার নেই। এর মধ্যে মহিষের মাংস না ঘোড়ার মাংস আমরা সেটি জানি না । এগুলো যদি মহিষ বা হালাল মাংসও হয়, সেগুলো এক বছর মেয়াদ দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। তার মধ্যে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে তা তো বোঝার উপায় নাই। আমরা চাই মাংসের দেশীয় বাজার ভালো থাকুক। আমরাও বেঁচে থাকি। এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত একাধিক মাংস বিক্রেতার সঙ্গে কৌশলে কথা বলে জানা যায়, প্যাকেটজাত হিমায়িত মহিষের মাংস পাইকারী কেজি মূল্য ২৫০ থেকে ৩০০টাকা কেজি। তবে তাঁত বাজারে গরুর মাংসের সঙ্গে প্যাকেটের মহিষের মাংস মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মমতাজ বেগম বলেন, কেউ যদি প্যাকেটজাত মহিষের মাংস গরুর মাংস বলে বিক্রি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যস্থা নেওয়া হবে।